ইমামত
ইমামত বা নেতৃত্বের ধারণা শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবেই একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। সুন্নি মাযহাবের অনুসারীগণ তাদের স্ব স্ব মাযহাবের মূল প্রণেতাকে ইমাম বা নেতা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। একইভাবে শিয়া মাযহাবের অনুসারীগণ তাদের মাযহাবের নেতৃস্থানীয় মূল ব্যক্তিবর্গকে ইমাম হিসেবে অভিহিত করেন। তবে শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমামত রাসুলের (সঃ) রেসালাতের মিশনের ধারাবাহিকতায় একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত দায়িত্বভার।
শিয়া মাযহাবের ইমামগণের সকলেই রাসুলের (সাঃ) পবিত্র বংশধর অর্থাৎ আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত এবং মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সঃ) কর্তৃক মনোনীত। (আহলে বাইত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের আলোকে জানতে ক্লিক করুন)
সুন্নি মাযহাবের ক্ষেত্রে ইমামগণের দায়িত্ব কেবলমাত্র ধর্মীয় বিধি বিধান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ এবং তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা খলিফার উপর নির্ভরশীল। অপরদিকে শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিতে রাসুলের পর তাঁর মনোনীত ইমামগণ ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল। রাসুলের (সঃ) এর হাদিস অনুযায়ী যেহেতু আহলে বাইত (“তাদের অগ্রে যেয়ো না তাহলে ধ্বংস হবে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়োনা তাহলে ধ্বংস হবে এবং তাদেরকে কিছু শেখাতে যেয়োনা যেহেতু তাঁরা তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী।, সুয়ুতি, ইবনে হাজার হায়সামি, ইবন আল আসির) সবচেয়ে জ্ঞানী, সেহেতু তারাই বিধি-বিধানের ব্যাখ্যায় সবচেয়ে উপযুক্ত। এবং সে আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনায় তারাই সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিত্ব।
যদিও আহলে বাইত সংক্রান্ত হাদিসসমূহ থেকে রাসুলের (সঃ) পর তাঁদের অনুসরণের বিষয়ে কোন ধোঁয়াশা থাকেনা তারপরও রাসুল (সঃ) তাঁর উত্তরাধীকার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে আদৌ কাউকে মনোনীত করে গিয়েছিলেন কিনা নাকি তিনি এব্যাপারে কোন প্রকার দিকনির্দেশনা ব্যতীত তাঁর উম্মতকে ছেড়ে গিয়েছেন সে প্রশ্নটি যৌক্তিকভাবেই উত্থাপিত হয়।
হাদিসে হযরত আলীকে উম্মতের অভিভাবক হিসেবে মনোনয়ন
রাসুল (সঃ) তাঁর জীবদ্দশায় হযরত আলীর ব্যাপারে যত প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করেছেন সেসব হাদিসের সংখ্যা এবং গুণগত বৈশিষ্ট্য সকল সাহাবিদের থেকে ব্যতিক্রম ও অনন্য। এসব হাদিস অধ্যয়ন করলে রাসুলের পর তাঁর উত্তরাধীকারি কে হবেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। কিন্তু এতসব বর্ণনার পরও রাসুল (সঃ) আরও সুস্পষ্ট করে এব্যাপারে আলাদাভাবে ঘোষণা প্রদান করেন তাঁর বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে। একারণে এটি গাদীরের হাদিস নামে অধিক প্রসিদ্ধ।
তাবরানী যাইদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সাঃ) ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে একটি বৃক্ষের নীচে একটি খুতবা পাঠ করেন যা এরূপ : হে লোকসকল! খুব শীঘ্রই আমি আমার প্রভুর পক্ষ হতে দাওয়াত পাব এবং আমি তা গ্রহণ করবো। আমি দায়িত্বশীল এবং এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হব এবং তোমরাও দায়িত্বশীল ও তোমাদের দায়িত্বের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে, তখন তোমরা আমার বিষয়ে কি বলবে? সকলে বলল, “আপনি আপনার ওপর আরোপিত রেসালতের দায়িত্ব পালন করেছেন, জিহাদ করেছেন, উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন।” রাসূল (সাঃ) বললেন, “তোমরা কি এ সাক্ষ্য প্রদান কর না, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ও মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, বেহেশত-দোযখ, মৃত্যু, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সবই সত্য? তোমরা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও কিয়ামতের বিষয়ে কি বিশ্বাস স্থাপন কর নি? তারা বলল, “হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।”
অতঃপর মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন।” অতঃপর তিনি ঘোষণা করেন, “হে লোকসকল! আল্লাহ্ আমার মাওলা ও অভিভাবক এবং আমি মুমিনদের অভিভাবক হিসেবে তাদের নিজেদের অপেক্ষা তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি।”
فمن كنت مولاه فهذا مولاه يعنى عليّا اللّهم وال من والاه و عاد من عاداه
সুতরাং জেনে রাখ আমি যার মাওলা বা অভিভাবক এই ব্যক্তি (আলীও) তার মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে, আর তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করুন যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে।”
হে লোকসকল! আমি তোমাদের পূর্বেই হাউজে কাওসারে উপস্থিত হব তোমরা হাউজের নিকট আমাকে পাবে। এ হাউজ বসরা হতে সানআ’র দূরত্ব হতেও দীর্ঘ এবং এর তীরে আকাশের তারকারাজির সংখ্যার মত রৌপ্য পাত্রসমূহ থাকবে। যখন তোমরা এ হাউজে আমার নিকট আসবে তোমাদের আমি দু’টি ভারী বস্তু (কোরআন ও আমার আহ্লে বাইত) সম্পর্কে প্রশ্ন করব যে, এ দু’য়ের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করেছ। প্রথম ভারী বস্তু আল্লাহর কিতাব যার এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে যা দ্বারা এটি আঁকড়ে ধরবে যাতে করে বিচ্যুত এবং পরিবর্তিত (আমার পরে) না হয়ে যাও এবং দ্বিতীয় ভারী বস্তু আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহ্লে বাইত যাদের সম্পর্কে সূক্ষ্মদর্শী পরম জ্ঞানী আল্লাহ্ আমাকে জানিয়েছেন এ দু’টি ভারী বস্তু হাউজে আমার সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”।
তাবরানী, ইবনে জারির, হাকিম, তিরমিযী সকলেই যাইদ ইবনে আরকাম হতে হাদীসটি ঠিক এভাবেই এনেছেন। ইবনে হাজার ও অন্যান্যরা এভাবেই তাবরানী হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটি নির্ভুল ও সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। দেখুন ‘সাওয়ায়েক’, পৃষ্ঠা ২৫।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল যাইদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণনা করেছেন, “আমরা রাসূলের সঙ্গে এক উপত্যকায় উপস্থিত হলাম যাকে ‘গাদীরে খুম’ বলা হত। সেখানে একটি বৃক্ষের সঙ্গে কাপড় ঝুলিয়ে ছায়া সৃষ্টি করা হলে নবী তার নীচে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলেন : তোমরা কি জান না এবং সাক্ষ্য দিবে না, আমি মুমিনদের ওপর তাদের হতে অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী? সবাই বলল : হ্যাঁ। অতএব, আমি যার ওপর ক্ষমতার অধিকারী (মাওলা) আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে এবং তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করুন যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে। (মুসনাদে আহমাদ, ৪র্থ খণ্ড, ৩৭২ পৃষ্ঠা)
নাসায়ী যাইদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণনা করেছেন, “যখন নবী (সাঃ) বিদায় হজ্ব হতে ফিরে আসছিলেন তখন ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে অবতরণ করলেন ও একটি বৃক্ষের তলা পরিষ্কার করার আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন : আমি আল্লাহ্র পক্ষ হতে দাওয়াত পেয়ে তা গ্রহণ করেছি। আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি যার একটি অপরটি হতে বৃহৎ; আল্লাহ্র কিতাব এবং আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত। আমার আহ্লে বাইতের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে সতর্ক হও কারণ তারা একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না যতক্ষণ না হাউজে কাউসারে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। অতঃপর বললেন : আল্লাহ্ আমার মাওলা (অভিভাবক) ও আমি মুমিনদেরও মাওলা (অভিভাবক) এবং আলীর হাত (উঁচু করে) ধরে বললেন : আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে এবং শত্রুতা করুন তার সঙ্গে যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা করে।”
আবু তুফাইল বলেন, “আমি যাইদকে প্রশ্ন করলাম : আপনি কি রাসূল (সাঃ) হতে এটি শুনেছেন? তিনি বললেন : ঐ বৃক্ষের নীচে এমন কোন ব্যক্তি ছিল না যে তার চক্ষু দিয়ে তা দেখে নি এবং কর্ণ দিয়ে তা শ্রবণ করে নি।”
এ হাদীসটি মুসলিম তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে যাইদ ইবনে আরকাম হতে কয়েকটি সূত্রে বর্ণনা করেছেন কিন্তু আহলে সুন্নাহর অন্যান্য হাদীসবেত্তার মত হাদীসটির শেষ অংশ কেটে বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
গাদীর এর হাদিস সুন্নীসূত্রে বর্ণিত মুতাওয়াতির হাদিস। নিচে কিছু রেফারেন্স দেয়া হল। আরো বিস্তারিত জানতে al-islam.org এর এই পেইজটি দেখতে পারেন।
১। গাজ্জালী, মাজমুআতুল রাসায়িল, পৃ. ৪৮৩।
২। ইবনুল কাথির, আল-বিদায়াহ ওয়া আল-নিহায়াহ, খন্ড-৫, পৃ. ২৩৩।
৩। আল-আলবানী, সিলসিলাত আল-আহাদীস আল-সহীহাহ, খণ্ড - ৪, পৃ. ৩৪৩।
৪। আল-সিমনানী, আল-উরওয়াহ লি-আহল আল-খালওয়াহ, পৃ. ৪২২।
৫। ইবনে হাজার ‘আসকালানী, তাহদীব আত-তাহদীব, খন্ড- ৭, পৃ. ২৯৭।
৬। আল-যহাবী, তাদকিরাত আল-হুফ্ফাজ, খণ্ড - ২, পৃ. ৭১৩।
৭। ইবনে কাসির, আল-বিদায়াহ ওয়া আল-নিহায়াহ, খন্ড- ১১, পৃ. ১৬৭।
৮। সহীহ মুসলিম, খন্ড. - ৪, পৃ. ১৮৭৩, হাদীস নং - ২৪০৮।
এ সম্পর্কিত আরও কিছু লেখা
[[শিয়া মাযহাবের মৌলিক বিশ্বাস]]
[[রাসুলের (সঃ) আহলে বাইত]]