শিয়া মাযহাবের মৌলিক বিশ্বাস
শিয়া মাযহাব এর বিশ্বাস অনুযায়ী উসুল-আল-দ্বীন বা দ্বীন এর মৌলিক বিশ্বাস মোট পাঁচটি –
১. তাওহীদ বা একত্ববাদ
তাওহীদ ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের মূল বিষয়। মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, কোন কিছুই তাঁর মতো নয়, তিনি অনাদি ও অনন্ত, যার কোন শুরু বা শেষ নেই, তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ, তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়, ন্যায়পরায়ণ, অস্তিত্বময়, সর্বদ্রষ্টা। মহান আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা। সৃষ্টির কোন গুণ দিয়ে তাঁকে গুণান্বিত করা যায় না। তাঁর কোন দেহ নেই, কোন অবয়ব নেই, তিনি বস্তুসত্তা (জাওহার বা Substance) নন এবং উপজাত (আরাজ বা Phenomena) নন, তিনি হাল্কা নন ও ভারী নন, তিনি স্থিতিশীল নন ও গতিশীল নন, তাঁর কোন স্থান নেই, কোন কাল নেই, কেউই তাঁর দিকে নির্দেশ করতে পারে না, যেহেতু কোন কিছুই তাঁর মতো নয়, কিছুই তাঁর তুল্য নয়, তাঁর কোন বিপরীত নেই, তাঁর কোন স্ত্রী বা সন্তান নেই, কোন কিছুই তাঁর তুল্য নয়।
তাঁর সত্তাগত (জাতগত) একত্ব থাকা আবশ্যক - তিনি সত্তাগতভাবে এক এবং অত্যাবশ্যকীয় অস্তিত্ব। তেমনি তাঁর গুণগত একত্ববাদের আবশ্যকতা রয়েছে - এ কারণে তাঁর গুণ, তাঁর সত্তা ভিন্ন কিছু নয়। অর্থাৎ তিনি দুটি বিষয়ের (সত্ত্বা ও গুণ) মিশ্রিত কোণ অস্তিত্ব নন, বরঞ্চ তাঁর সব কিছুই এক ও অদ্বিতীয়। একইভাবে তাঁর উপাসনার ক্ষেত্রে একত্ববাদ হচ্ছে তিনি ভিন্ন অন্য কারো উপাসনা বৈধ নয়।
২. নবুওয়াত বা রিসালাত
নবুওয়াত হলো একটি ঐশী দায়িত্ব এবং আল্লাহর মিশন। তিনি এ কাজে তাঁদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন যাঁদেরকে তিনি তাঁর যোগ্য ও পরিপূর্ণ মানবতার মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে অন্যান্য মানুষের নিকট প্রেরণ করেছেন যাতে তাঁরা মানুষের ইহ ও পরকালীন লাভ ও কল্যাণ সম্পর্কে বর্ণনা এবং চারিত্রিক কলুষতা, শয়তানী কর্মকাণ্ড ও ক্ষতিকর আচরণ থেকে মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে নবি হিসেবে কাউকে মনোনয়ন, নির্ধারণ ও নির্বাচনের অধিকার দেননি। কেবল মহান আল্লাহই নবি হিসেবে কাউকে মনোনয়ন ও নির্বাচন করতে পারেন। কারণ, আল্লাহই ভালো জানেন যে কে তাঁর বাণী বহনের উপযুক্ত। সুতরাং পথ প্রদর্শক, সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে মহান আল্লাহ যাঁদেরকে পাঠিয়েছেন তাঁদের সাথে বিতর্ক করার অধিকার কারো নাই। সেরূপ কারো অধিকার নেই যে, বিধান, সুন্নাত ও শরীয়ত হিসেবে নবিরা যা এনেছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ করবে। আর নবুওয়াত বা রিসালাতে বিশ্বাসের মাধ্যমে মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত পূর্বের সকল আসমানি কিতাব, সকল নবি ও ফেরেশতাকুলে বিশ্বাস অপরিহার্য।
৩. কিয়ামত ও আখিরাত
মহান আল্লহর ইচ্ছায় কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবে এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থান দিবসে সবাইকে নতুন করে জীবিত করবেন এবং সৎকর্মকারীকে পুরস্কৃত করবেন আর পাপীকে শাস্তি দিবেন।
মানুষের চূড়ান্ত পুরস্কার ও শাস্তিপ্রাপ্তির দিন হলো হাশরের ময়দান, যেদিন হিসাব-কিতাবের জন্য মিযান বা মানদণ্ড স্থাপিত হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে। মানুষ মৃত্যুর পর কবর ও বারজাখের জীবন অতিবাহিত করার পর পুনরুত্থিত হবে।
যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ ও বিধিবিধান পালন করবে, সে এমনকি হাবশী দাস হলেও মুক্তি পাবে ও সফলতা লাভ করবে অর্থাৎ প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হবে। এক্ষেত্রে বর্ণ ও বংশের কোন ভেদ নেই। আর যদি কেউ তাঁর নির্দেশ অমান্য করে, তাঁর প্রণীত বিধিবিধান উপেক্ষা করে অন্য কোন বিধিবিধান গ্রহণ ও অনুসরণ করে তবে সে যদি কুরাইশ বংশের নেতাও হয়, তাহলেও অপমান ও শাস্তির উপযুক্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
অপর দুটি বিষয় হচ্ছে -
৪. মহান আল্লহর ন্যায় বিচারে বিশ্বাস
মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারক ও প্রজ্ঞাবান। তিনি ন্যায় ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে সৃষ্টি করেন। কোন কিছুই তিনি উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করেন না, হোক তা পাথর, উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ, পৃথিবী বা আকাশমণ্ডলী। কারণ, উদ্দেশ্যহীন কর্ম প্রজ্ঞা ও ন্যায়ের পরিপন্থী। তদুপরি তা মহান আল্লাহর প্রভু ও উপাস্য হিসেবে সকল ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণতার অধিকারী হওয়ার আবশ্যকতারও পরিপন্থী। তিনি কখনোই কারো প্রতি জুলুম বা অন্যায় করেন না। তিনি সকল অপবিত্রতা ও খারাপ গুণাবলী থেকে মুক্ত ও পবিত্র, ফলে তাঁর অন্যায় না করা, তাঁর স্বাধীনতার পরিপন্থী নয় যেমনটি অনেকে অজ্ঞতাবশত মনে করে থাকে।
৫. ইমামত
মহানবি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর উম্মতকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্বের বিষয়টি সামনে এসে যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সঃ) ও উলিল আমরকে (৪:৫৯) মেনে চলার যে নির্দেশনা এসেছে সে অনুসারে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে উলিল আমরগণ আসলে কে বা কারা।
যেহেতু কুরআন মূলনীতি প্রদান করে থাকে, তাই তার ব্যাখ্যর প্রয়োজন রয়েছে। অপরদিকে প্রতিটি দল ও মতের অনুসারীরা পবিত্র কুরআনকে তাদের নিজেদের মত করে ব্যাখ্য করার প্রয়াস চালায়।
এদিক থেকে মনোনীত ইমামের দায়িত্ব হলো যেমনভাবে রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় মুসলমানদের পরিচালনা করেছেন, দিক নির্দেশনা ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাদের জন্য দ্বীনি বিধিবিধান বর্ণনা করেছেন, চিন্তাগত জটিল সমস্যাসমূহের সমাধান দিয়েছেন, সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের নিষ্পত্তি করেছেন সর্বোপরি তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন - তেমনিভাবেই কুরআন ও রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী তা পালন করা।
শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে এমন ব্যক্তি বা ইমাম আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সঃ) কর্তৃকই মনোনীত হবেন। এটি এমন বিষয় নয় যে জনগণ এক্ষেত্রে যাকে খুশি নির্বাচিত করে নেয়ার অধিকার রাখে।
মহানবি (সা.) বলেন : ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত। যদি তোমরা এ দু’টিকে আঁকড়ে ধর, কখনই বিভ্রান্ত হবে না।’ (সহিহ মুসলিম ও তিরমিযি)
কুরআনের বহু আয়াত ও রাসুলের (সঃ) অসংখ্য হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী ইমামত তাই রাসুলের (সঃ) আহলে বাইত থেকেই নির্দিষ্ট।
শেষ নবির উম্মত হিসেবে রাসুল (সঃ) আনীত দ্বীন পরিপূর্ণ স্বকীয়তায় টিকিয়ে রাখতে এবং যোকোন বিভ্রান্তি থেকে ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করতে ইমামত তাই অপরিহার্য একটি বিষয়।
তাই ইমাম রাসুলের (সঃ) উত্তরসূরি হিসেবে ইসলামী সরকারের নেতৃত্ব ছাড়াও দ্বীন-দুনিয়ার সকল বিষয়ের পরিচালনার জন্য দায়িত্বশীল।
এ সম্পর্কিত আরও কিছু লেখা
[[ইমামত]]
[[রাসুলের (সঃ) আহলে বাইত]]